বুধবার ● ২১ জুন ২০১৭
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭ ও বৈষম্যনীতি নিয়ে কিছু কথা
জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭ ও বৈষম্যনীতি নিয়ে কিছু কথা
নির্মল বড়ুযা মিলন :: (৭ আষাঢ় ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪.৪৫মি.) সোমবার ১৯ জুন ২০১৭ জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভার নিয়মিত বৈঠকে নীতিগত ভাবে পাশ করা হয়েছে “জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭”। জাতীয় সম্প্রচার আইনে প্রস্তাবিত সম্প্রচার কমিশন নামে একটা কমিশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রী পরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের জানান, দেশের প্রচলিত গণমাধ্যম নীতিমালার আলোকেই অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা করা হয়েছে। জাতীয় সম্প্রচার কমিশন আইন পাশ হলে অনলাইন গণমাধ্যম সমূহকে কমিশনের কাছে নিবন্ধন নিতে হবে। এর ফলে বাংলাদেশে প্রথমবারের মত অনলাইন গণমাধ্যম সরকারের তদারকির আওতায় নেয়া হচ্ছে।
দেশ এগিয়ে চলছে ডিজিটাল যুগে, দেরিতে হলেও এধরনের যুগ উপযোগি উদ্যোগ নেয়াতে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের নীতি নির্ধারকদের অনলাইন গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে সাধুবাদ জানাই।
অনলাইন গনমাধ্যমকে একটি কাঠামোতে আনার লক্ষ্যে ঢাকায় পর পর অনলাইন নিউজ পোর্টাল মালিকদের সাথে বৈঠক করেন সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। তথ্যমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই।
সরকার এবং তার নীতি নির্ধারকদের অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সময় সামনে অপেক্ষা করছে।
অনলইন গনমাধ্যমের কেউ কেউ অতি উৎসাহিত হয়ে ফুল নিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবছেন। তাদের ভাবনা অমুলক নয়। তাই জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭ আইনে অনলাইন গনমাধ্যমের প্রতি বৈষম্যনীতি নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন মনে করছি।
মন্ত্রী পরিষদ সচিব বলেছেন অনলাইন যেন সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে কাজ করে সে উদ্দেশ্য নিয়ে “জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭” করা হচ্ছে। একথাটির সাথে নীতিগত ভাবে একমত পোষণ করছি। কিন্তু মন্ত্রী পরিষদ সচিব সাংবাদিকদের জানান প্রস্তাবিত আইনে যেসব পত্রিকা ও টেলিভিশন অনলাইন ভার্সনে পরিচালনা করে আসছে তাদের অনলাইনে নিবন্ধন নিতে হবে না, অফলাইনের নিবন্ধন নিয়ে অনলাইনে কাজ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু অনলাইনের নিবন্ধন নিয়ে অফলাইনে কাজ করার সুযোগ রাখা হয়নি। আইনে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যাও হাতে নেই। এই আইনে একটি বিশেষ মহল উপকৃত হবে কিন্তু প্রকৃত অনলাইন গণমাধ্যম এর প্রকাশক ও সংবাদকর্মীরা নিরুৎসাহিত হবে। ফলে অনলাইন গণমাধ্যম মুখ থুবরে পরবে। যেমনটি দেখা গেছে গত কয়েক বছরে শত শত অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিষ্ক্রীয় হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
তারপরেও অফলাইনের নিবন্ধন নিয়ে অনলাইনে আসাটা দোষের কিছু না, কিন্তু এখানে উভয়ের জন্য সম সুযোগ রাখা না হলে অনলাইন গণমাধ্যমের মালিকদের জন্য আইনটি হয়ে উঠবে বৈষম্যমূলক একটি আইন।
২০০১ সালের পর বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে এই কথাটি সত্য। অনলাইন গনমাধ্যম এর মধ্যে সংবাদ প্রকাশের অনলাইন নিউজ পোর্টাল, অনলাইন টেলিভিশন ও অনলাইন রেডিও উল্লেখযোগ্য।
অনলাইন গনমাধ্যম বিষয়ে সরকারের ভিতর দুই ধরনের মতামত লক্ষ্য করা গেছে, এক হচ্ছে অনলাইন গণমাধ্যমকে নামমাত্র রেজিষ্ট্রেশন ফি নিয়ে অনলাইন গণমাধ্যমকে সরকারের তালিকায় নিয়ে আসা। অন্যটি হচ্ছে মোটা অংকের রেজিষ্ট্রেশন ফি ও প্রতি বছর নবায়ন ফি নির্ধারন করে অনলাইন গণমাধ্যমকে সরকারের তালিকায় নিয়ে আসা। এছাড়া আমলাতন্ত্রের জটিলতায় ফেলে অনলাইন গনমাধ্যম এর প্রচার, প্রসার ও উন্নয়ন রোধ করা।
সরকারের নীতি নির্ধারকদের ভিতর অনলাইন গনমাধ্যম বিষয়ে পরিস্কার ধারনাও প্রশ্নবিদ্ধ ।
সরকারের নীতি নির্ধারকদের এটা বুঝা উচিত অনলাইন গনমাধ্যম কোন কাগজের পত্রিকা নয়, কাগজের পত্রিকা গুলি সরকারী অনুমোদন লাভের সাথে সাথে সরকার থেকে বিনামূল্যে কাগজ বরাদ্ধ পায় এবং ডিএফপি’র মাধ্যমে বিজ্ঞাপন পান। অনলাইন গনমাধ্যম শুরু থেকে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, কিন্তু অনলাইন গণমাধ্যমের প্রকাশকরা আশায় বুক বেঁধে কাজ করে যাচ্ছেন যেন অনলাইন গণমাধ্যম শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে গৌরবের সাথে পরিচিতি করাতে পারে। অনলাইন গণমাধ্যম কোন বিজ্ঞাপণ পায়না, যারা পায় তারা হাতে গোনা কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও অনলাইন টেলিভিশন মালিকদের লোক দেখানো একটি কমিটিতে রাখা হয়েছে, তারা যে মতামত দিয়ে ছিলেন তাদের সেসব মতামত “জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭” স্থান পায়নি।
“জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭” এ আইনে স্টোক হোল্ডার অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও অনলাইন টেলিভিশন মালিকদের মতামতের সুযোগ না রেখে এমন একটি আইন সংসদে পাশ করার আগে সরকার প্রধানের আরেকবার ভেবে দেখা উচিৎ। যাদের জন্য এ আইন তৈরী করা হচ্ছে তাদের মতামত গুরুত্ব দেওয়া বাঞ্চনীয়।
“জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭” আইনটি ভালভাবে দেখার সুযোগ হয়নি, তারপরও সংবাদে পড়ে এই আইনটিতে অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য বেশ কয়েকটি জায়গায় বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরন করা হয়েছে মনে হয়। সরকারের দৃষ্টিতে সকল গণমাধ্যম সম মর্যাদার ভিত্তিতে দেখা উচিৎ। কেননা সরকার যদি প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য একটি আইন, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার জন্য একটি আইন, অনলাইন মিডিয়ার জন্য একটি আইন, চলচিত্র শিল্পর জন্য একটি আইন ও লেখক প্রকাশকদের জন্য আলাদা একটি আইন প্রণয়ন করেন তাহলে দেখা যাবে একই দেশে একাধিক আইনে প্রচার প্রচারনা হচ্ছে, বিষয়টি সরকার এবং গণমাধ্যম ও লেখক প্রকাশকদের কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবেনা। এসব গণমাধ্যম গুলি শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষমও হবেনা। যদি আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সফলতার সহিত কাজ শুরু করতে পারে তাহলে অনলাইন গণমাধ্যম হয়ে উঠবে দেশের জনগনের কাছে মূলধারার গণমাধ্যম। এজন্য অনলাইন গণমাধ্যমের মালিক বা প্রকাশকরা বছরের পর বছর ভুর্তুকি দিয়ে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অনলাইন গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রেখেছেন। অনলাইন গণমাধ্যমের মালিক বা প্রকাশকরা স্বপ্ন দেখেন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সফলভাবে কাজ শুরু করবে, সেদিন হয়তো বেশী দূরে নেই মানুষের হাতের মুঠোয় অনলাইন গণমাধ্যম থাকবে। যখন খুশি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, অনলাইন টেলিভিশন ও অনলাইন রেডিও ব্যবহারের সুযোগ পাবে। সরকার অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য আজ পর্যন্ত সরকারীভাবে কোন অর্থ ব্যয় করেনি, এটি স্পষ্ট। কিন্তু অনলাইন গণমাধ্যম সরকারী কোষাগারে বৈদেশিক আয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা উপার্জনের কাজ করে যাচ্ছে। অনলাইন গণমাধ্যম এর সংবাদ কর্মীরা সকল ক্ষেত্রে সরকারী প্রতিটি উন্নয়ন মূলক কাজে ভুমিকা রাখেন এবং সরকারের যেকোন জরুরী সংবাদ পৃথিবীর সকল প্রান্তে দ্রুত পৌঁছে দিচ্ছেন। আইনের মার প্যাঁচে পরে অনলাইন সংবাদকর্মী ও মালিকরা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারার মামলায় বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানী করা হচ্ছে। অথচ অনলাইন গণমাধ্যম এবং অনলাইন গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য “জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭” আইনে কি সুবিধা রাখা হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেননি মন্ত্রী পরিষদ সচিব।
আমাদের দেশে একটি প্রবাদ মনে পড়ে গেল,“ভাত,কাপড় দেয়ার মুরত নাই,কিলমারার গোসাই”।
দেশের আমলারা কেবল আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যেকোন উন্নয়ন কার্যাবলীর ফাইল লাল ফিতায় বন্দী করে রেখে দিতে পছন্দ করেন। এবারও “জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭” আইন তারই ঈঙ্গিত বহন করছে। নীতিমালা অনুযায়ী অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনা পদ্ধতি কমিশন জানিয়ে দিবে, কিন্তু কমিশন কাদের দ্বারা গঠিত হবে, কারা থাকবেন এই কমিশনে বিষয়টি ষ্পষ্ট নয়।
আইনে অনলাইন গনমাধ্যমকে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে উঠার সুযোগ রাখা হয়নি এবং ডোমেইন কোম্পানী সমুহকে তাদের কর্মকান্ড একই আইনে যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল।
মন্ত্রী পরিষদ সচিব আরো বলেছেন, কোন বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হলে সম্প্রচার কমিশনের কাছে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে, সম্প্রচার কমিশন ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করবে। অভিযোগের ব্যাখ্যায় সচিব বলেন, অনলাইন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কোন তথ্য উপাত্ত যদি কোন নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের অধিকার ক্ষুন্ন করে, কাউকে যদি আহত করে তিনি কমিশনের কাছে অভিযোগ করবেন। কমিশন দুই পক্ষকে শুনানী দেওয়ার পরে নির্দেশনা ও জরিমানা করতে পারবে। এখানে অনলাইন গনমাধ্যমকে তার মুক্তমত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে।
কেউ যদি অন্য দেশের ঠিকানায় দেশে বসে অনলাইন গনমাধ্যম পরিচালনা করেন তখন সরকার বা কমিশন কি করবেন ? সে বিষয়টিও আইনে থাকা জরুরী। কোন কোন নিউজ পোর্টাল কেবল একটি উপজেলার সংবাদ প্রকাশ করে, কোনটি জেলার সংবাদ, কোনটি বিভাগীয় আবার কোনটি সারা দেশের সংবাদ প্রকাশ করে। “জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭” আইনে পোর্টালগুলির শ্রেণী বিন্যাস থাকা অত্যাবশ্যক।
অনলাইন গনমাধ্যম একটি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্ভবনাময় খাত এটা সরকারকে বুঝে নিতে হবে।
সচিব বলেছেন, অনলাইন গণমাধ্যমের নিউজ পোর্টাল অনলাইন টেলিভিশন ও অনলাইন রেডিও নিবন্ধনের জন্য কমিশন ফি নির্ধারন করে জমা নেবে। যেখানে সরকার হাজার হাজার সংবাদপত্র বিনা ফি’তে নিবন্ধন দিয়ে সরকারী সকল সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে, সেখানে অনলাইন গণমাধ্যম নিবন্ধনের জন্য ফি নির্ধারন করে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে অনলাইন গণমাধ্যম শিল্প উন্নয়নে নিরুৎসাহিত করা।
এখানে সরকারকে সমালোচনা করা আমার মূল উদ্দেশ্য নয়, আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, আইনে কোন কোন বিষয় একক নীতি প্রনয়ন করা হয়েছে তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা। আমি একজন অনলাইন গণমাধ্যম ষ্টোক হোল্ডার, কোন আইনটি জরুরী সেটা আমার মতন অনলাইন গণমাধ্যম ষ্টোক হোল্ডার বা সুবিধাভোগীরা বেশী বুঝবেন এবং জানবেন। আমলারা সেটা বুঝতে চাইবেন না, কারণ তারা অনলাইন গণমাধ্যমকে তাদের লাল ফিতার ফাইলে বন্দি করে রাখতে আগ্রহ বেশী। যেমন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও অনলাইন টেলিভিশন নিবন্ধনের জন্য সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে ২ হাজার আবেদন পত্র জমা দেওয়া রয়েছে, কিন্তু আবেদনকারীদের আবেদন পত্র কোন অবস্থায় রয়েছে আমলারা সেটা পর্যন্ত জানাতে কার্পণ্য করেন। এসব আবেদনকারীরা আদৌ নিবন্ধন পাবে কিনা সেটাও রহস্যে ঘেরা।
সুতরাং অনলাইন গণমাধ্যম এর প্রচার, প্রসার ও উন্নয়ন চাইলে জনস্বার্থে স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করার পরিবেশ তৈরী করে বৈষম্যনীতি পরিহার করে সমঅধিকার ও সম মর্যাদার ভিত্তিতে “জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা -২০১৭” চুড়ান্ত করার আগে বিশেষ মহলের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি আরেকবার খতিয়ে দেখার জন্য সরকারের নীতি নির্ধারকদের কাছে অনুরোধ রইল।
লেখক : নির্মল বড়ুয়া মিলন
প্রকাশক
সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম।