মঙ্গলবার ● ২১ মে ২০১৯
প্রথম পাতা » গবেষনা » কাপ্তাই লেকে মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে করণীয় ও পরামর্শ
কাপ্তাই লেকে মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে করণীয় ও পরামর্শ
আজহার আলী :: বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান অনস্বীকার্য। জাতীয় জিডিপিতে মৎস্য খাতের অবদান ৩.৫৭ শতাংশ। দেশের মোট কৃষিজ আয়ের ২৫ দশমিক ৩০শতাংশ যোগান দেয় মৎস্য খাত । দেশের প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৬০ ভাগ আসে মাছ থেকে। রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪ শতাংশ মৎস্য খাতের অবদান। দেশের মোট জনগোষ্ঠির ১১ শতাংশের অধিক লোক মৎস্য সেক্টর থেকে জীবিকা নির্বাহ করে।
কাপ্তাই হ্রদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় সমূহের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং একই সাথে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কৃত্রিম ভাবে তৈরী বৃহত্তর হ্রদ সমূহের মধ্যেও অন্যতম। বৃহত্তর পার্বত্য চট্রগ্রামে অবস্থিত এই হ্রদটির আয়তন প্রায় ৬৮,৮০০ হেক্টর, যা পুকুর সমূহের মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২% এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯% সম আয়তনের। মূলত ১৯৬১ সনে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে তৈরী হলেও মৎস্য উৎপাদন, দেশী ও বৈদেশিক মূদ্রা উপার্জন, জেলে এবং মৎস্য ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জীবন-জীবিকা থেকে শুরু করে দেশের সামগ্রিক মৎস্য সেক্টরে কাপ্তাই হ্রদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। কাপ্তাই হ্রদ দেশীয় মৎস্য প্রজাতির এক বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধশীল জল ভান্ডার। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী এ হ্রদে ২ প্রজাতির চিংড়ি ও মোট ৭৫ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ। তম্মধ্যে ৬৭টি প্রজাতির মাছ হচ্ছে দেশীয় এবং ০৮ টি হচ্ছে বিদেশী প্রজাতি। কাপ্তাই লেকে ২০০২-০৩ অর্থ বছরে মাছের উৎপাদন ছিল ৪৫৬৬ মেঃ টন যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০১৪০ মেঃ টন হলে ও রুই জাতীয় মাছের উৎপাদন (২০০২-০৩ অর্থ বছরে ২৫৮.৭৫ মেঃ টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫৭.৬৭ মেঃ টন) ক্রমানয়ে হ্রাস এবং ছোট প্রজাতির মাছের উৎপাদন (২০০২-০৩ অর্থ বছরে ৩৪০০.১৯ মেঃ টন এবং ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৬২৩৩.৯০ মেঃ টন) ক্রমানয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণা কার্যক্রম বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের নদী উপকেন্দ্রের মাধ্যমে কাপ্তাই হ্রদ ভিত্তিক বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৬-৮৭ সাল হতে।
উপ কেন্দ্র থেকে এ যাবৎ হ্রদের মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পরিচালিত গবেষণা কার্যক্রম সমূহকে প্রধানতঃ ৫ (পাঁচ) টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
যেমন : ১. হ্রদের জলাশয়তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও উৎপাদন শীলতা সম্পর্কীয় গবেষণা;
২. মৎস্য জীব-বৈচিত্র, উৎপাদন এবং প্রজাতি বিন্যাসে হ্রাস-বৃদ্ধি ও পরিবর্তনের গতি ধারা সম্পর্কীয় গবেষণা;
৩. বিকল্প মৎস্য চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন সম্পর্কীয় গবেষণা;
৪. বানিজ্যিক গুরুত্ব সম্পন্ন প্রজাতি সমূহের প্রাকৃতিক প্রজনন ও প্রজনন স্থল সমূহের অবস্থা নিন্ম রূপ সম্পর্কীয় গবেষণা;
৫. মৎস্য সম্পদ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কীয় নিয়মিত ও ধারাবাহিক গবেষণা।
কাপ্তাই লেকে মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে করণীয় ও পরামর্শ
প্রাকৃতিক প্রজনন :
প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রজননের অন্ততঃ ১ মাস পূর্বে অর্থাৎ মে মাসের শুরু থেকে মৎস্য শিকার বন্ধ ঘোষণা
করতে হবে;
রুই জাতীয় মাছসহ ছোট প্রজাতির মাছের পোনা বড়না হওয়া পর্যন্ত কমপক্ষে ৩ মাস মৎস্য শিকার বন্ধ রাখতে হবে;
ডিম ওয়ালা মাছের অভিপ্রায়ন পথসমূহ চিহ্নিত করে প্রজনন মৌসুমে এসব এলাকায় যন্ত্র চালিত বোট চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করতে হবে।
আহরণ পদ্ধতি :
ছোট ফাঁসের কারেন্ট জাল, ছোট ফাঁস যুক্ত বড় মাছের জাঁক উচ্ছেদ করতে হবে;
নলা মাছসহ ছোট মাছ ধরার বড়শী ও ছোটবড়শী নিসিদ্ধ করতে হবে;
মৎস্য শিকার শুরুর প্রথম এক মাস মশারী কাপড়ের কেচকী জাল বন্ধ রাখতে হবে;
ছোট প্রজাতির বড় আকারের মাছ আহরণের সুবিধার্থে মশারীর কাপড়ের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত বড় ফাঁস বিশিষ্ট
ফ্যাক্টরীর জাল দিয়ে তৈরী কেচকী জাল ব্যবহার করতে হবে;
সচেতনতাবৃদ্ধি ও পাহারার মাধ্যমে কেচকী জালে দৃত রুই জাতীয় পোনা ও ছোট মাছের নিধন বন্ধ করতে হবে;
প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইনসেনটিভ দিয়ে হলেও ব্যাপক হারে বড় আকারের কেচকী, চাপিলাসহ ছোট প্রজাতির মাছ আহরণ করতে উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে।
পোনা মজুদ :
বিএফডিসির নিজস্ব পোনা উৎপাদন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে;
কমপক্ষে ২৫% পোনা প্রাকৃতিক প্রজননের (হালদা বা যমুনা নদীর) হতে হবে;
পোনার গুণগতমান নিশ্চিত হওয়ার নিমিত্তে সরবরাহকারীর পোনারনমুনা বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে যাচাই করতে হবে;
পোনাসরবরাহকারীর brood stock এর গুণগতমান ও breeding পদ্ধতি বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে পোনার সরবরাহ নিতে হবে ;
মজুদকৃত পোনা সংরক্ষণ এবং বা চাঁহার ও বৃদ্ধি পরিবীক্ষণের জন্য পৃথক কর্মসূচী থাকতে হবে।
ডিমওয়ালা মাছ ও প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণ
হ্রদেরউজান এলাকায় স্থানান্তরিত ও পলিভরাট হয়ে যাওয়া প্রজননস্থল ও প্রজনন অভিপ্রায়ন পথ সমূহ খনন/ ড্রেজিং এর মাধ্যমে পূনরুদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ইতিমধ্যে ইনস্টিটিউট কর্তৃক চিহ্নিত প্রজননক্ষেত্র ও প্রজনন অভিপ্রায়ণ পথগুলোতে মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
পৃথক জনবল ও বিশেষ কর্মসূচীর মাধ্যমে ও প্রয়োজন বোধে বিদ্যমান আইন সংস্কারের মাধ্যমে হ্রদের মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন অবাধ ও নিরাপদ রাখতে হবে।
কাপ্তাই লেকে দূষণ এবং প্রতিকার :
কাপ্তাই লেকের পাশে অবস্থিত বিভিন বাজার থেকে ময়লা, আবর্জনা এবং লেকের পাশে বসবাসকারীদের বাসা থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ময়লা, আবর্জনাসহ অন্যান্য দব্যাদি লেকের পানি দূষিত করে।
অসচেতন ভ্রমণকারী পলিথিন, বিভিন্ন বোতলসহ খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ কাপ্তাই লেকে সরাসরি ফেলেযা দূষনের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
কাপ্তাই লেকের পাশে অবস্থিত বিভিন্ন গাছ পালার পাতা পড়ে লেক দূষিত হয়।
উপরোক্ত বিষয় গুলো হতে কাপ্তাই লেক রক্ষা করার জন্য যথাযথ আইন প্রয়োগ এবং জনসচেতন তা আরো বাড়াতে হবে।
ব্যবস্থাপনা কৌশল উন্নয়নের মাধ্যমে কাপ্তাই লেকে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ভবিষৎপরিকল্পনা :
মাছের প্রজনন মৌসুমে বিশেষ করে মে মাসের শুরু থেকে পরবর্তী ৪ মাস লেকে মাছ শিকার বন্ধ রাখা।
জীব-বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সারা বছর পানি থাকে লেকের এমন স্থানে অধিক সংখ্যক অভয়াশ্রম স্থাপন করা। এতে মাছের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যম মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
লেকে জাঁক ব্যবহার করে মৎস্য আহরণ বন্ধ করা।
লেকের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে আন্ত প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় জোরদার করণ।
লেখক : আজহার আলী
ঊর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট
নদী উপ কেন্দ্র, রাঙ্গামাটি।
ই-মেইল : [email protected]