বৃহস্পতিবার ● ২৩ ডিসেম্বর ২০২১
প্রথম পাতা » ফিচার » জনপ্রতিনিধিকে সর্বশ্রেষ্ঠ জনসেবক হতে হবে
জনপ্রতিনিধিকে সর্বশ্রেষ্ঠ জনসেবক হতে হবে
হাফিজুল ইসলাম লস্কর,সিলেট প্রতিনিধি :: বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার বিভাজনে আমরা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করি। তাই সমাজের প্রতি আমাদের অনেক দায়-দায়িত্ব রয়েছে। তেমনি দেশের নাগরিক হিসেবে দেশের প্রতিও আমাদের কতিপয় দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। দায়িত্ব ও কর্তব্যের মাধ্যে অন্যতম একটি হলো ভোট প্রদানের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা।ভোট প্রদান করা আমাদের নাগরিক অধিকার এবং দায়িত্ব। ভোটের সময় আমরা দলবেঁধে ভোট দিই।
কিন্তু নিরপেক্ষভাবে আমাদের রাজনীতির চরিত্র বিশ্লেষণ করলে ভোট প্রদানে আমাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বেড়ে যায়। কাকে ভোট দেব? কাকে বানাব জনগণের প্রতিনিধি? আমাদের দুর্ভাগ্য, হতাশা, অসহায়ত্ব এই ভোট প্রদানকে কেন্দ্র করেই। মাঝে-মাঝে এমন প্রশ্নও জাগে, আমরা আসলে কেন ভোট দেই? আমাদের ভোটে যদি কোনো দুর্নীতিবাজ, অর্থলোভী, ক্ষমতালিপ্সু জনপ্রতিনিধি হয়ে আসেন, তাতে আমাদের কী লাভ? দেশের কী লাভ? এসব প্রশ্ন জনগণকে মানবতার কাঠগড়ায় দাঁড় করায় বারবার। তারপরও আমরা ভোট দিতে যাই! আমাদের ভোটেই নির্বাচিত হয়ে আসেন প্রিয় জনপ্রতিনিধিরা।
জনগণের বিপুল সমর্থনে যিনি নির্বাচিত হন তিনি জননেতা। আমাদের প্রত্যাশা আর স্বপ্নপূরণের প্রতিনিধি। কিন্তু আমরা কেমন বোকা সরল ভোটার সেটা বুঝতে পারি যখন আমাদের ভোটে পার পেয়ে নেতাজি লাপাত্তা হয়ে যান। ভোটের আগে কী জনদরদি চরিত্র তাদের। চেনা-অচেনাকে দেখা মাত্রই বুকে জড়িয়ে ধরেন। হাতে হাত মেলান। কুশল জানেন। আর ভোটের পরের বিজয়ী এই নেতার পার্থক্য পিলে চমকানোর মতো। ভোটের আগের নেতা কী অসাধারণ, সৎ, উদার, নিরহঙ্কারী, আবেগী ও সেবক মানুষ। হাটে, ঘাটে, মাঠে, অলিগলিতে চষে বেড়ান জনগণের দুয়ারে দুয়ারে। ভোট ভিক্ষা করেন। হাতে-পায়ে ধরেন। রাত-বিরাতে জনগণের কাছে ছুটে যান। আর হাজারো প্রতিশ্রুতির মন ভোলানো কথার ঝুড়ি দিয়ে হৃদয় জয় করে নেন আমাদের। আর ভোটের পরের নেতা- জনপ্রতিনিধি হলে পাল্টে যায় সেই দৃশ্যপট। তবুও জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে হয়। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের গুরুত্ব সীমাহীন।
একটি অগ্রসরমাণ জাতির জন প্রতিনিধির মধ্যে কী কী গুণ থাকা উচিত, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যস্থা হিসেবে ইসলাম সেটি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। তাই আসুন দেখি ইসলাম জনপ্রতিনিধির মাধ্যে কি কি গুণ এর কথা উল্লেখ করেছে।
(১) তাকওয়া বা আল্লাহভীতিঃ
যেকোনো জনপ্রতিনিধি সর্বপ্রথম তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়া আবশ্যক। আল্লাহভীতি ও তাকওয়া মুমিনকে সর্বদা নিজ কর্তব্য পালনে তৎপর রাখে। বৈধ-অবৈধতার সীমারেখায় তাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ মুত্তাকি বা আল্লাহভীরু ব্যক্তি ছোট-বড় সব কাজেই পরকালীন জবাবদিহিতার কথা চিন্তা করে। তাই আল্লাহভীরু, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিই জনপ্রতিনিত্বের সম্মানজনক আসনে সর্বাধিক উপযুক্ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের একজন মাত্র পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর তোমাদের বিভিন্ন দল ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিতি অর্জন করতে পারো। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত সে, যে সবার চেয়ে বেশি মুত্তাকি।’ (সুরা আল-হুজুরাত, আয়াত : ১৩)।
(২) আমানতদারি ও ন্যায়পরায়ণতাঃ
সাধারণত নির্বাচনী এলাকার ও সেখানে বসবাসকারী জনগণের কল্যাণে প্রয়োনীয় সরকারি-বেসরকারি সহায়তা ও অনুদান এসে থাকে জনপ্রতিনিধির মাধম্যে। সুতরাং জনপ্রতিনিধি আমানতদার না হলে জনগণ বঞ্চিত হবে। এলাকায় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের উন্নয়ন হবে না। ফলে জনপ্রতিনিধি আমানতদার ও ন্যায়পরায়ণ হওয়া অত্যাবশ্যক। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের আদেশ করছেন যে তোমরা আমানতকে তার উপযুক্ত প্রাপকের কাছে পৌঁছিয়ে দেবে। আর মানুষের মাঝে যখন কোনো বিষয়ে বিচার-ফয়সালা করবে, তখন অবশ্যই ইনসাফের ভিত্তিতে তা করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপদেশ দিচ্ছেন। আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও দেখেন। (সূরা আন্-নিসা : ৫৮)।
(৩) চরিত্র ও ব্যবহার মানোত্তীর্ণ হওয়াঃ
এক হাদিসে আছে একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষকে আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম কোনটি? রাসুল (সা.) বলেন, উত্তম চরিত্র। (মুসনাদে আবু দাউদ, হাদিস : ১৩২৯)
জনপ্রতিনিধি অবশ্যই উন্নত চারিত্রিক গুণাবলির অধিকারী হওয়া চাই। কারণ চরিত্রহীনকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ঘৃণা করে। আল্লাহ তাআলাও তাকে পছন্দ করেন না। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) আমাকে ইয়েমেনের গভর্নর হিসেবে পাঠানোর সময় শেষ অসিয়ত হিসেবে বলেন, ‘তুমি অবশ্যই তোমার চরিত্রকে সুন্দর করবে। কারণ মানুষের মধ্যে যার চরিত্র বেশি সুন্দর, সে দ্বীনদারির দিক থেকেও তাদের মধ্যে উত্তম। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং : ২১৯৮৯)।
(৪) হৃদয়বান ও জনদরদি হওয়াঃ
জনপ্রতিনিধি আন্তরিক, হৃদয়বান ও জনদরদি হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ জনপ্রতিনিধি যদি জনতার প্রতি ভালোবাসা না রাখে, জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক যদি বন্ধুত্বপূর্ণ না হয়, তাহলে তার দ্বারা জনগণের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়।
ভালোবাসা ও আন্তরিকতার মাধ্যমেই জনপ্রতিনিধি এলাকার জনগণ ও মহান আল্লাহর প্রিয় ও আস্থাভাজন হয়ে ওঠা সম্ভব। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অনুগ্রহ ও দয়াবানদের ওপর দয়াময় আল্লাহ দয়া ও অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। সুতরাং জমিনের অধিবাসীদের ওপর তোমরা দয়া করো, তাহলে আসমানওয়ালা—অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়া করবেন। (বুখারি ও মুসলিম)।
(৫) জনসেবার মন-মানসিকতাঃ
জনসেবার মানসিকতা জনপ্রতিনিধির আবশ্যিক অনুসঙ্গ। জনগণের সেবা করতে না পারলে তাদের নেতা হওয়ার কোনো স্বার্থকতা নেই। আরবিতে বিখ্যাত প্রবাদ রয়েছে, ‘আমিরুল কওমি খাদিমুহুম’—অর্থাৎ জাতির নেতা তিনি, যিনি তাদের সেবক। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হয়েও রাসুল (সা.) উম্মতের সেবা করে গেছেন জীবনভর। সাহাবায়ে কেরামও (রা.) রাসুল (সা.)-এর এ শিক্ষা ও আদর্শ লালন করেছিলেন। ফলে তাদের শাসনামলে জনসাধারণ উন্নত জীবনযাপনের পাশাপাশি বেশ শান্তি-সুখ ও সমৃদ্ধিতে ছিলেন।
তাই জনগণের জনপ্রতিনিধি হতে হলে, নেতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ জনসেবক হতে হবে। আর এরকম নেতা বা জনপ্রতিনিধিই জনগনের কাম্য।