

রবিবার ● ২২ জুন ২০২৫
প্রথম পাতা » কুষ্টিয়া » কুষ্টিয়ায় শীর্ষ সন্ত্রাসী লিপ্টনকে বাঁচাতে তৎপর উপসচিব এর ভাই কবির
কুষ্টিয়ায় শীর্ষ সন্ত্রাসী লিপ্টনকে বাঁচাতে তৎপর উপসচিব এর ভাই কবির
কে এম শাহীন রেজা, কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি :: দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থি সংগঠন গণমুক্তিফৌজের শীর্ষ সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর কবির লিপ্টনকে বাঁচাতে তার ভাই নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আলমগীর কবির বাইরন স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নানাভাবে প্রভাব খাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তার প্রভাবেই সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গুলিসহ তার নিজ বাড়ী থেকে গ্রেফতার করা হলেও মামলায় তাকে চার নম্বর আসামি করেছে পুলিশ। সহযোগীদের করা হয় প্রধান আসামি। অস্ত্র-গোলাবারুদের মামলায় মাত্র একদিনের রিমান্ড নিয়ে তাদের জামাই আদরে রেখে ফের কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী লিপটনের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন, মিছিল-সমাবেশ ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন সচেতন নাগরিক সমাজ। প্রশাসনের শীর্ষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে জানা যায়, আব্দালপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ছাত্রলীগ নেতা খসরুর ভাই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থি নেতা জাসদ গণবাহিনীর সামরিক প্রধান কুষ্টিয়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী কালুও বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রভাব খাটিয়ে যাচ্ছেন তাকে রক্ষা করার জন্য।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার রাতে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের জোতপাড়ার আতিয়ার খাঁকে ফসলের মাঠে হত্যা করে কালু, লিপ্টন ও সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সংগঠনিক সম্পাদক কাঞ্চনপুর ইউপি চেয়ারম্যান আনিচুর রহমান ঝন্টু। অথচ উক্ত হত্যা মামলায় জোতপাড়া এলাকার ১৯ জন নীরিহ ব্যক্তির নামে মামলা করেন তার ছেলে। তার ৪ দিন পরই ২১ শে ফেব্রুয়ারী ২০২৫ রাত আনুমানিক ১০:৩০ টার দিকে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর মাঠের মধ্যে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা হানিফ আলীসহ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করেছে কালু ও লিপ্টন। এরপর থেকেই নতুন করে আতংক হিসেবে কালু ও লিপ্টনের নাম কুষ্টিয়ার আশেপাশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। হত্যার বিষয়ে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর নেতা কালু নিজেই দায় স্বীকার করে গণমাধ্যমকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এ বিষয়ে লিপ্টনকে পুনরায় রিমান্ডে নিলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে।
উল্লেখ্য গত ৬ জুন কুষ্টিয়ার দূর্বাচারা গ্রামে অভিযান চালিয়ে তিন সহযোগীসহ লিপটনকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনীর চৌকশ একটি দল। লিপটনের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, গুম, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। গ্রেফতারের সময় লিপটন ও সহযোগীদের কাছ থেকে বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও দেশীয় বিভিন্ন ধরনের ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন সেনা সদস্যরা। এরপরই আইনের ফাঁক গলিয়ে লিপটনকে বের করে নেওয়ার তৎপরতা শুরু করেন তার ভাই আলমগীর কবির। অভিযোগ আছে-মামলার মেরিট দুর্বল করতে তিনি পুলিশকে চাপ দিয়ে লিপটনকে চার নম্বর আসামি করতে বাধ্য করেন। এজাহারে দেখা গেছে, আসামি তালিকার এক নম্বরে আছে লিপটনের সহযোগী পূর্বচারা গ্রামের জহির বিশ্বাসের ছেলে লিটন বিশ্বাস, দুই নম্বরে রফিকুল ইসলামের ছেলে রাকিবুল হাসান, তিন নম্বরে আব্দুল মজিদের ছেলে সনেট ও চার নম্বরে লিপটনের নাম রয়েছে। সহযোগীকে প্রধান করে লিপটনকে আসামি তালিকার চার নম্বরে রাখায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, ৯০-এর দশকে কলেজ ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি লিপটনের। পরবর্তীকালে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অতিমাত্রায় সক্রিয় চরমপন্থি সংগঠন গণমুক্তিফৌজে নাম লেখালেও গভীর সখ্যতা রাখে জাসদ গণবাহিনীর সামরিক প্রধান কুষ্টিয়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী ত্রাশ কালুর সাথে। কুষ্টিয়া শহরে প্রকাশ্যে জামাই বাবুসহ একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে আলোচনায় আসেন লিপটন। এর পর তার অপরাধ নেটওয়ার্ক আশপাশের জেলায় বিস্তৃত হয়। ২০১৩ সালের দিকে মাহবুব-উল আলম হানিফকে তার এলাকায় ফুলের তোড়া দেওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসেন এই চরমপন্থি লিপ্টন। মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানের ক্ষমতাবলে নিজ এলাকার নিরীহ এক ইউপি মেম্বার সহ প্রায় ২০/২৫ জনকে র্যাবের মাধ্যমে তুলে এনে অস্ত্র রাখার অভিযোগ দিয়ে কারাগারে পাঠানোর পর হাজার হাজার নারী-পুরুষ তার বিরুদ্ধে মহাসড়ক অবরোধ করে মিছিল-সমাবেশ করেছিল। এছাড়া ২০১৫ সালে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে গাজীপুরের একটি রিসোর্ট থেকে র্যাব তুলে নিয়ে যায়। এরপর তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি। এ ঘটনার জন্য সবুজের পরিবার হানিফকে দায়ী করে মামলা করেছে। অভিযোগ আছে, র্যাবকে দিয়ে সবুজকে অপহরণের পেছনে সরাসরি জড়িত থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে। ভয়ে লিপটনের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেনি পরিবার। কালুর সাথে গোপন সখ্যতার কারনে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকলেও গত রমজানের আগে কুষ্টিয়ার স্থানীয় বিএনপি নেতা জাকির সরকারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ফের প্রকাশ্যে এসে অপরাধ জগতে সক্রিয় হয়েছিলেন লিপটন। ইতিমধ্যে জাকির সরকারের সঙ্গে লিপটনের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
প্রশাসনের শীর্ষ একটি গোয়েন্দা সংস্থা আরো জানান, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী গাঁ ঢাকা দেয়। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলা গুলোতে আতংকের নাম হয়ে উঠেছে জাসদ গণবাহিনীর সামরিক প্রধান শীর্ষ সন্ত্রাসী কালু ও গণমুক্তিফৌজের শীর্ষ সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর কবির লিপ্টনকে ঘিরে। তারা জানায়, এই দু’জন শীর্ষ সন্ত্রাসী কালু ও লিপ্টন গত ১৫ জানুয়ারি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ভাদালিয়ায় অবস্থিত জেটি ইন্টারন্যাশনাল (জাপান টোব্যাকো) বাংলাদেশ লিমিটেডে বোমা ও গুলি বর্ষন করে। ২ ফেব্রুয়ারী কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জাতীয়তাবাদী শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের কর্মী সম্মেলন চলাকালীন সময়ে দুপুর ২টার দিকে এই দুই চরমপন্থী সন্ত্রাসী সীমানা প্রাচীরে উঠে অফিস প্রাঙ্গণের দিকে এলোপাথাড়ি গুলি করে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারী কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নের সৈয়দ মাসউদ রুমী সেতুর নিচে বালুর ঘাটে কালুর লোকজন ভাড়ি ভাড়ি অস্ত্রের মুখে ফিল্মি স্টাইলে জিম্মি করে টাকা পয়সা লুটে নেয় ১ জনের পায়ে গুলি করে ও ২ জন কে ধরে নিয়ে যায়। ১৯৯৮ সালে কুষ্টিয়া সদরের পার্শ্ববর্তী এলাকা মিরপুর উপজেলার কলাবাড়িয়ায় ৫ জনকে জবাই করে হত্যা করে। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে আলামপুর ইউনিয়নের দহকুলা গ্রামের তমছের ও মানা ২ জনকে প্রকাশ্য দিবালোকে নওয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গুলি করে হত্যা করে। ওই একই সালে ঝিনাইদহ শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে কুষ্টিয়ার পশ্চিম আব্দালপুরের রায়হান ও মজিদ মিয়াকে প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে গুলি করে ও জবাই করে হত্যা করে। ১৯৯৯ সালে কুষ্টিয়া সদরের কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের জোতপাড়া গ্রামের শুকুর মালিথাকে গুলি করে ও জবাই হত্যা করে। ২০০২ সালে পূর্ব আব্দালপুরের তাছের কে জবাই করে হত্যা করে। ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঝিনাইদহের শৈলকুপার ত্রিবেনী গ্রামের মাঠে শেখপাড়া গ্রামের শহিদ খা, ত্রিবেনী গ্রামের শাহনেওয়াজ, একই গ্রামের ফারুক, নুরু কানা ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর গ্রামের কটাকে গুলি করে ও জবাই করে একই সাথে ৫ জনকে হত্যা করে। ২০০৯ সালের ৮ আগস্ট তিনজনকে হত্যা করে কুষ্টিয়া শহরের সাদ্দাম বাজার এলাকায় গণপূর্ত কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ব্যাগের ভেতর তিনটি মানুষের মাথা ঝুলিয়ে রেখে যায়। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ রাত ১ টার দিকে ভারতের নদীয় জেলার চাপড়া থানার ছোট আন্দুলা গ্রামে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুরের চেয়ারম্যান আনুকে স্বাসরোধ করে জবাই করে হত্যা করে। ২০১২ সালে কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের আজিবার চেয়ারম্যানকে ভারতের নদীয়া জেলার ধানতোলা থানা এলাকায় জবাই করে হত্যা করে। একই সালে কুষ্টিয়া ইবি থানাধীন লক্ষীপুর বাসস্ট্যান্ডে আব্দালপুর এলাকার রহমান ও হাসেম নামের দুই জনকে গুলি করে ও জবাই করে হত্যা করে এই দু’জন সন্ত্রাসী।
এদিকে লিপ্টনের গ্রেফতারের দিনই (৬ জুন) এলাকার লোকজন শহরের এনএস রোডে ও ১৫ জুন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেন। কুষ্টিয়ার সচেতন নাগরিক সমাজের ব্যানারে হাজার হাজার নারী-পুরুষ তাতে অংশ নেয়। মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
এ বিষয়ে জানতে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আলমগীর হোসেনের মোবাইলে কল করে প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে তার ভাই লিপটনের মামলায় প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আমি মিটিংয়ে আছি। মামলার বাদী হরিনারায়ণপুর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাকে ডেকে নিয়ে যেভাবে মামলা করতে বলেছে আমি করেছি। এ ব্যাপারে আপনি সিনিয়র অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) থানার অফিসার ইনচার্জ মেহেদী হাসান বলেন, ঈদের ছুটির মধ্যে তাড়াহুড়া করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এক ও চার নম্বর আসামি কোনো বিষয় নয়। তদন্তে অপরাধের ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী সিরিয়াল করে চার্জশিট দেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি নিজের দোষ স্বীকার করে বলেন, দোষ সব আমাদের। একদিনের রিমান্ডে নেওয়া-আনা ও মেডিকেল করাতেই সময় শেষ হয়ে যায়। তাহলে জিজ্ঞাসাবাদ কখন করবো।
কুষ্টিয়ার সচেতন নাগরিক সমাজ বর্তমান তত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্শন করে বলেন, দীর্ঘদিন শান্ত থাকা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলা গুলোতে আবার চরমপন্থীদের কর্মকাণ্ড জোরদার হয়ে উঠেছে। এঁটা দমন করতে সবুজ গুম, সম্প্রতি ট্রিপল মার্ডার ও আঁতিয়ার খাঁর হত্যার প্রত্যক্ষ খুনী সদ্য আটককৃত সন্ত্রাসী লিপ্টনকে নতুন করে রিমান্ড নেওয়ার জোর দাবী জানান। সেই সাথে ফ্যাসিষ্ট সরকারের আমলে নিয়োগ প্রাপ্ত লিপ্টনের ছোট ভাই নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আলমগীর কবিরকে দ্রুত চাকরী থেকে বরখাস্ত করার জন্যও জোর দাবী জানান। কারন, এই উপসচিব আলমগীর কবির বাইরন লিপ্টনের মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।