শুক্রবার ● ১ মে ২০২০
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » করোনাকালে মহান মে দিবস ও শ্রমিকশ্রেণী : সাইফুল হক
করোনাকালে মহান মে দিবস ও শ্রমিকশ্রেণী : সাইফুল হক
এবার এক বৈশ্বিক দুর্যোগের মধ্যে গোটা দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণী তথা শ্রমজীবী- মেহনতি মানুষকে শ্রমিকশ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস- মহান মে দিবস পালন করতে হচ্ছে।মে দিবস শ্রমিকশ্রণীর ঐক্য আর সংঘবদ্ধতার প্রতীক। শ্রম দাসত্বের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠা আর মুক্তি অর্জনের শপথ নেবার দিন। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিরোধ আর রক্তের ধারা ওখানেই শেষ হয়ে যায়নি। ৮ ঘন্টা শ্রম, ৮ ঘন্টা বিনোদন আর ৮ ঘন্টা বিশ্রামের মানবিক দাবি ছড়িয়ে পড়ে আটলান্টিক, প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরের কুলে কুলে, মহাদেশ থেকে মহাদেশে। শ্রমঘন্টা হ্রাস, ন্যায্য মজুরীর অর্থনৈতিক দাবি কালক্রমে রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করে; নির্মম, অমানবিক ও শোষণমূলক শ্রমদাসত্বভিত্তিক মুনাফানির্ভর রাজনৈতিক ব্যবস্থার বদল ঘটিয়ে সাম্যভিত্তিক মানবিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে আসে।এই সংগ্রামের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জিত হয় ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। রাশিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে শ্রমদাসত্বের বিলোপ ঘটানো হয়; শ্রমিকশ্রেণী অর্জন করে তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার; সৃষ্টি হয় মানুষে-মানুষে নতুন সম্পর্ক, এক নতুন মানবিকতা, এক নতুন সভ্যতা।
মতাদর্শিক চৈতন্য আর রাজনৈতিক এই দিশায় পরবর্তী কয়েক দশকে বিশ্ব ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা বিস্তৃত হতে থাকে; শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশ, শোষণ ও বৈষম্যমূলক ব্যক্তিমালিকানার অবসান করে সামাজিক মালিকানায় উত্তরণ, অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান-কর্মসংস্থানের মত মৌলিক মানবিক চাহিদাসমূহ পূরণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের বহুমুখী বিশাল কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সমগ্র মানবজাতির সামনে এক ঐতিহাসিক সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করে। সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এসব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতার মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণী কেবল নিজেকে মুক্ত করেনি; মুক্তির দিগন্ত উন্মোচন করে গোটা সমাজ, শ্রেণী ও পুরুষতান্ত্রিক শোষণে জর্জরিত নারী সমাজ ও পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠির। সম্ভব করে অসম্ভবকে; মানবজাতির কয়েক হাজার বছরের শ্রেণীভিত্তিক সমাজের কথিত বাস্তবতাকে পরিবর্তন করে শ্রেণীবিহীন সমাজের সম্ভাবনাকে বাস্তবিক ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে হাজির করে।
রুশ বিপ্লবের ৭২ বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় ও ভেঙে পড়ার মধ্য দিয়ে এই ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞ হোচট খেয়েছে, ছত্রভঙ্গ হয়েছে সন্দেহ নেই। সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের পূর্ব অভিজ্ঞতার ঘাটতি, মতাদর্শিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি; পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার শতধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডের কারণে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পিছু হটেছে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পরবর্তী চারদশকে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা শ্রমজীবী- মেহনতি মানুষসহ পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের জন্য টেকসই কোন মানবিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। বরং এই সময়কালে শ্রমিকশ্রেণীসহ শ্রমজীবী- মেহনতি মানুষ আরো বিপন্ন, অধিকারহীন ও ক্ষমতাহীন হয়েছে। সম্পদের বিশাল পুঞ্জিভবন ও কেন্দ্রীভবন হয়েছে; ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আরো প্রকট ও অমানবিক হয়েছে; দুনিয়াজুড়ে সমাজের একাংশের চরম দারিদ্র আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির কৌশলে দেশে দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। কেবল বাংলাদেশেই প্রতিবছর শ্রমের বাজারে ১৭ থেকে ১৮ লক্ষ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। উৎপাদন ব্যবস্থায় বহুজাতিক সংস্থা ও কর্পোরেট স্বার্থের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ আরো জোরদার হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরোক্ষ প্রভাবে পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মত সামাজিক সুরক্ষার খাতে রাষ্ট্রের যেটুকু দায়বদ্ধতা ও ভূমিকা গড়ে উঠেছিল পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই গত ক’দশকে তাকে সংকুচিত করা হয়েছে। শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষসহ স্বল্প আয়ের কোটি কোটি মানুষের ন্যূনতম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের সামাজিক ও জনকল্যাণমুখী ভূমিকা থেকে অনেক রাষ্ট্র ও সরকার নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে।
দুনিয়াজুড়ে করোনা মহামারী তথা কোভিড- ১৯ প্রাণঘাতি ভাইরাসের বিস্তার অর্থনৈতিক-সামাজিকভাবে সবচেয়ে বেশী আঘাত হেনেছে শ্রমজীবী- মেহনতি মানুষের উপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ, ব্রাজিল, ইকুয়েডর, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানসহ সংক্রমণ আক্রান্ত দেশসমূহে এর মধ্যেই কোটি কোটি মানুষ তাদের চাকুরী হারিয়েছেন।এর মধ্যে ১৬০ কোটি মানুষ কর্ম হীন হয়ে জীবিকা নষ্ট হওয়ায় তারা নিঃস্ব থেকে আরো নিঃস্ব হয়েছেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারাও অনেকটা সর্বশান্ত হয়েছেন। অভিবাসী কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ পড়েছেন মহাবিপদে।তাদের এক বড় অংশ কাজ হারিয়ে জরুরী খাদ্য ও ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়ে বিপদে দিন পার করছেন। সপ্তাহ দুই আগে পিপিআরসি ও বিআইজিডি’র জরীপে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে ৭১% শ্রমজীবী মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এদের বড় অংশের কাছে এখনও পর্যন্ত সরকারি বরাদ্দের কিছুই পৌঁছায়নি। লকডাউনের সিদ্ধান্ত তাদের জীবনকে আরো বিপর্যস্ত করেছে, জীবিকা হারিয়ে বাংলাদেশে এক থেকে দেড় কোটি পরিবার জীবন বাঁচিয়ে রাখার গভীর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছেন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যুদ্ধের মত মানবসৃষ্ট সংকটের মত করোনা মহামারীর আসল অভিঘাত এসে পড়েছে স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী- মেহনতি মানুষের উপর। করোনা ভাইরাস শ্রেণী, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে আক্রান্ত করলেও চরম দুর্দশায় নিক্ষেপ করেছে কোনরূপ সঞ্চয়হীন পৃথিবীর কোটি কোটি মেহনতি পরিবারসমূহকে। লকডাউনের কোন আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তই তাদেরকে ঘরবন্দী রাখতে পারছে না। জীবিকার খোঁজে তাদেরকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে হচ্ছে; তা না হলে করোনায় মারা যাবার আগে তাদেরকে হয়তে না খেয়েই মরতে হবে। দুনিয়ার অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও এই পর্যন্ত কার্যকরি ও টেকসই ‘গণবন্টন ব্যবস্থা’ বা ‘সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী’ গড়ে ওঠেনি। যেটুকু যা আছে তাও চুরি, দুর্নীতি, দলীয়করণের কারণে প্রত্যাশিত ফল দিতে পারছে না। এবারকার করোনা দুর্যোগে বাংলাদেশে তা আরো মারাত্মকভাবেই ধরা পড়েছে।
করোনা দুর্যোগ প্রবল বৈষম্য ও অন্যায্য বিশ্বব্যবস্থার চেহারা উদোম করে দিয়েছে। গণস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও খাদ্যের মত মৌলিক খাতসমূহ কি পরিমান অবহেলিত তাও এখন প্রতিদিন ধরা পড়ছে। বহু দশক ধরে চলে আসা ‘চুইয়ে পড়া অর্থনৈতিক নীতি’ বা প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রীক কৌশল যে সমাজের এক বড় অংশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, পারছে না করোনাকালে তা আবার প্রমাণীত হল।
মহামারীজনীত দুর্যোগের এরকম একটি ঝুঁকির মধ্যে এবার বাংলাদেশের শ্রমিক- মেহনতি মানুষ মে দিবস উদযাপনের পরিবর্তে কোন রকমে জীবন-জীবিকা বাঁচিয়ে রাখতে তৎপর। বিত্তশালী ও স্বচ্ছল মধ্যবিত্তরা যখন করোনা সংক্রমণ এড়িয়ে চলতে ঘরে থাকছেন তখন লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকসহ শ্রমজীবীদের নানা অংশ, দিনমজুরেরা জীবন বাজী রেখেই কারখানায় ঢুকছেন, কর্মস্থলে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন; যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত সুরক্ষা বলতে কিছু নেই; সামাজিক দূরত্ব রেখে কাজের পরিবেশও নেই। গার্মেন্টস মালিকদের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তে ৪-৫ এপ্রিল প্রবল দুর্ভোগ মোকাবিলা করে শ্রমিকদেরকে কর্মস্থলে ছুটে আসতে হয়েছে। এবারও চাকরি টিকিয়ে রাখতে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে ২৬-২৭ এপ্রিল থেকে তাদেরকে আবার কাজে যোগ দিতে হয়েছে। ছাটাই আর লে-অফ অব্যাহত রয়েছে; বকেয়া মজুরির দাবিতে এই মে দিবসেও শ্রমিকদের বিক্ষোভ করতে হচ্ছে। রাষ্ট্র ও সরকার কিভাবে শেষঅব্দি মালিকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় করোনা মহামারীকালেও শ্রমিকেরা তা দেখেছে।
করোনা মহামারী ধনতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার স্ববিরোধীতা, সংকট ও অসহায়ত্বকে আরো একবার সামনে নিয়ে এসেছে। মুনাফাকেন্দ্রীক বিদ্যমান উন্নয়ন দর্শন ও তার অন্তস্থিত গভীর অমানবিক ও চরম বৈষম্যের ক্লেদাক্ত চেহারাকেও আরেকবার প্রকাশ করে দিয়েছে। সমস্যা খাদ্যের স্বল্পতা নয়, সমস্যা যে সমবন্টনের- এই সত্যকেও এখন বারেবারে জানান দিয়ে চলেছে। বৈশ্বিক এই অন্যায্য ও অমানবিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া করোনার মত দুর্যোগ থেকে আমরা যেমন বিশ্বকে রক্ষা করতে পারবো না, তেমনি পৃথিবীর বিপুল অধিকাংশ শ্রমজীবী- মেহনতিদের জন্য বৈষম্যহীন মানবিক ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা যাবে না।
এবারবার মে দিবসে বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণীও পরিবর্তনের এই মতাদর্শীক ও রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হবে, সংগঠিত হবে- এটাই প্রত্যাশা।
সাইফুল হক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।