

বৃহস্পতিবার ● ৩১ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » কুষ্টিয়া » সন্ত্রাসী লিপ্টন-কালুর সেকেন্ড ইন কমান্ড মুকুল মেম্বার গ্রেপ্তার
সন্ত্রাসী লিপ্টন-কালুর সেকেন্ড ইন কমান্ড মুকুল মেম্বার গ্রেপ্তার
কে এম শাহীন রেজা, কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি :: শতাধিক হত্যা মামলার আসামি চরমপন্থী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর প্রধান কালু ও জেলার আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর কবির লিপটনের সেকেন্ড ইন কমান্ড মুকুল মেম্বারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার দুপুর ২টার দিকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের হরিপুর বাজার থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মুকুল মেম্বার নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলন, চাঁদাবাজি, দখলদারি, ডাকাতি, অস্ত্র, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। তার বিরুদ্ধে থানায় ৫টি মামলা রয়েছে।
২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আন্দোলনকারী সবুজ হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। চরমপন্থী সংগঠনের আঞ্চলিক শীর্ষ সন্ত্রাসী মুকুল মেম্বার কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পুরাতন কুটিয়া এলাকার মুসলিম বিশ্বাসের ছেলে। বিদেশে পালাতক কুষ্টিয়ার আব্দালপুর ইউনিয়নের আলী রেজা সিদ্দিকী ওরফে কালু ও জাহাঙ্গীর কবির লিপ্টনের নির্দেশে মুকুল বিভিন্ন সন্ত্রাসী অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন।
এর আগে, গত ৬ জুন ভোরে কুষ্টিয়ায় সেনা অভিযানে চরমপন্থী দলের ধূর্ধর্ষ নেতা, অস্ত্র ব্যবসায়ী ও হত্যাসহ অপরাধ কর্মের হোতা শীর্ষ সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর কবির লিপটনকে (৪৮) ৭টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গুলি-ম্যাগজিন এবং দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। সেসময় লিপটনের ৩ সহযোগিকেও আটক করে পুলিশ। তারা হলেন- মো. রাকিব (৩৮), মো. লিটন (২৬) ও মো. সনেট হাসান (৪৫)। লিপটন আটক হলেও এখনো ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছে চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর প্রধান আলী রেজা সিদ্দিকী কালু।
মুকুল মেম্বার গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে অবৈধ বালু উত্তোলন, নৌপথে চাঁদাবাজি, হত্যা, অস্ত্রের মুখে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করাসহ নানান অভিযোগ রয়েছে। মুকুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দায়ের করা একটি হত্যা মামলার তদন্তে অভিযুক্ত। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। মুকুলকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে হরিপুর এলাকার অবৈধ বালু ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও এলাকাবাসীরা জানায়, মুকুল মেম্বার চরমপন্থি নেতা ও বালু মহলের অঘোষিত সম্রাট হিসেবে পরিচিত কালু ও লিপটন বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হরিপুর ও পদ্মা নদী তীরবর্তী এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও অস্ত্রের মুখে সাধারন মানুষকে জিম্মি করে চাঁদাবাজির সাথে জড়িত ছিলেন। কালু ও লিপটনের নির্দেশনায় যারা নানা অপরাধ অপকর্ম করে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছে তাদের একজন এই মুকুল। কালু ও লিপটনের আরেক সহযোগী রাজু। তিনি তাদের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবেও পরিচিত। গত ২৩ জুন রাতে রাজু আহমেদকে পশ্চিম আব্দালপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) থানা পুলিশ। আটক রাজু আহমেদ কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুর গ্রামের রিয়াজুল ইসলামের ছেলে ও শীর্ষ সন্ত্রাসী কালুর চাচাতো ভাই। ইবি থানার মধুপুরে সংঘঠিত টুটুল হত্যাকান্ডে জড়িত থাকায় তাকে আটক করে পুলিশ। রাজু আটকের পর থেকে কালু ও লিপটনের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রনের দায়িত্বে ছিলেন মুকুল মেম্বার। এদিকে চরমপন্থীদের আগ্রাসনে আবারো অশান্ত জনপদে পরিণত হয়েছে সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়াসহ আশপাশের ৫টি জেলা। দীর্ঘ দেড় দশক পর এই জেলাগুলোতে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে একাধিক চরমপন্থী সংগঠন। জেলার হাট-বাজার, বালুমহল, পদ্মা ও গড়াই নদীর চর দখল এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তারা। যার কারণে প্রতিনিয়ত হত্যা, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। চরমপন্থী সংগঠনগুলোর প্রধান নেতৃত্ব দানকারীসহ তাদের সহযোগীদের ধরতে উঠে পরে লেগেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও ইতিমধ্যে তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক ইউনিট।
কালুর সহযোগী রাজুকে আটকের পর আদালতে দাখিলকৃত পুলিশ প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানা যায়, ইবি থানা পুলিশের হাতে আটক আসামী রাজু আহমেদ চরমপন্থী সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর প্রধান কালুর সেকেন্ড ইন কমান্ড। কুষ্টিয়া জেলাসহ ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী, পাবনা, নাটোর এলাকার অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী এই কালু। কালুর একাধিক নাম, বড় কালু ওরফে আলী রেজা ওরফে বুলবুল ওরফে কমল দা। কালু একাধিক মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী। তিনি বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে পলাতক থেকে তার বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে উল্লেখিত অঞ্চল সমূহের হাট-বাজার, বালু মহল, পদ্মা ও গড়াই নদীর চর দখল এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মাঠ পর্যায়ে আসামী রাজু তার সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কাজ করছে। রাজু প্রতিদিন একাধিক বার অডিও/ভিডিও কলে তার কথা বলে মাঠ পর্যায়ের সার্বিক অবস্থা তাকে জানান এবং বিভিন্ন হাট, বাজার, বালুর ঘাট, টেন্ডার ইত্যাদি থেকে আদায়কৃত অর্থের নির্দিষ্ট অংশ কালুকে প্রেরন করে। এছাড়া অস্ত্র কেনা-বেচায় জড়িত তারা এবং গত বছরের ৫ আগষ্ট কুষ্টিয়া মডেল থানা থেকে অস্ত্র লুট করে বিক্রি করেছেন রাজু। টুটুল হত্যাকাণ্ডে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয় বলে নিশ্চিত করেছে থানা পুলিশ।
প্রশাসনের শীর্ষ একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোতে আতংকের নাম হয়ে উঠেছে জাসদ গণবাহিনীর সামরিক প্রধান শীর্ষ সন্ত্রাসী কালু ও গণমুক্তিফৌজের শীর্ষ সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর কবির লিপটন। এই দু’জন শীর্ষ সন্ত্রাসী কালু ও লিপটন গত ১৫ জানুয়ারি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ভাদালিয়ায় অবস্থিত জেটিআই ইন্টারন্যাশনাল (জাপান টোব্যাকো) বাংলাদেশ লিমিটেডে বোমা ও গুলি বর্ষন করে। ২ ফেব্রুয়ারী কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড জাতীয়তাবাদী শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের কর্মী সম্মেলন চলাকালীন সময়ে দুপুর ২টার দিকে এই দুই চরমপন্থী সন্ত্রাসী সীমানা প্রাচীরে উঠে অফিস প্রাঙ্গণের দিকে এলোপাথাড়ি গুলি করে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারী কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নের সৈয়দ মাসউদ রুমী সেতুর নিচে বালুর ঘাটে কালুর লোকজন ভাড়ি ভাড়ি অস্ত্রের মুখে ফিলি স্টাইলে জিম্মি করে টাকা পয়সা লুটে নেয় ১ জনের পায়ে গুলি করে ও ২ জনকে ধরে নিয়ে যায়।
এর আগে, ১৯৯৮ সালে কুষ্টিয়া সদরের পার্শ্ববর্তী এলাকা মিরপুর উপজেলার কলাবাড়িয়ায় ৫ জনকে জবাই করে হত্যা করে কালু-লিপটন ও তার সহযোগীরা। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে আলামপুর ইউনিয়নের দহকুলা গ্রামের তমছের ও মানা নামে দুই ব্যাক্তিকে প্রকাশ্য দিবালোকে নওয়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে গুলি করে হত্যা করে এই সন্ত্রাসীরা। ওই একই সালে ঝিনাইদহ শহরের চুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে কুষ্টিয়ার পশ্চিম আব্দালপুরের রায়হান ও মজিদ মিয়াকে প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে গুলি করে ও জবাই করে হত্যা করে তারা। ১৯৯৯ সালে কুষ্টিয়া সদরের কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের জোতপাড়া গ্রামের শুকুর মালিখাকে গুলি ও জবাই হত্যা করে কালু ও লিপটন বাহিনীর সদস্যরা।
এছাড়া ২০০২ সালে পূর্ব আব্দালপুরের তাহেরকে জবাই করে হত্যা, ২০০৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঝিনাইদহের শৈলকুপার ত্রিবেনী গ্রামের মাঠে শেখপাড়া গ্রামের শহিদ খা, ত্রিবেনী গ্রামের শাহনেওয়াজ, একই গ্রামের ফারুক, নুরু কানা ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর গ্রামের কটাকে গুলি ও জবাই করে হত্যা, ২০০৯ সালের ৮ আগস্ট তিনজনকে হত্যা করে কুষ্টিয়া শহরের সাদ্দাম বাজার এলাকার গণপূর্ত কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ব্যাগের ভেতর তাদের মাথা ঝুলিয়ে রেখে যায় তারা। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ রাত ১ টার দিকে ভারতের নদীয়া জেলার চাপড়া থানার ছোট আন্দুলা গ্রামে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পশ্চিম আব্দালপুরের চেয়ারম্যান আনুকে স্বাসরোধ করে জবাই করে হত্যা করে কালু বাহিনী। ২০১২ সালে কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের আজিবার চেয়ারম্যানকে ভারতের নদীয়া জেলার ধানতোলা থানা এলাকায় জবাই করে হত্যা করে এই বাহিনী। একই সালে কুষ্টিয়া ইবি থানাধীন লক্ষীপুর বাসস্ট্যান্ডে আব্দালপুর এলাকার রহমান ও হাসেম নামের দুই জনকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে এই দু’জন সন্ত্রাসী ও তাদের সহযোগীরা।
অন্যদিকে গত বুধবার কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী লিপটনকে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল কুষ্টিয়া মডেল থানায় দায়ের করা আরও একটি বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আদালতে জমা হওয়া ওই মামলার এজাহার অনুযায়ী জানা যায়, কুষ্টিয়া সদর থানাধীন জগতি সুগার মিল কোয়ার্টার মাঠের পশ্চিম পাশে আওয়ামী লীগের লোকজন অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ ও নাশকতার উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছেন। তাদের হাতে ছিল এক্সপ্লোসিভ ও দেশীয় তৈরি ধারাল অস্ত্র। মামলার বাদীর মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় তারা ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিকবিদিক দৌড়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও অন্যরা পালিয়ে যায়।
ইতিপূর্বে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শীর্ষ সন্ত্রাসী লিপটনকে তিন খুনের মামলায় শৈলকুপা থানার আবেদনে পুনঃ গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এ মামলার আসামি হিসেবে তাকে গত ১ জুলাই কুষ্টিয়া কারাগার থেকে ঝিনাইদহ কারাগারে নেওয়া। গত ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কমান্ডার ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলার আহাদনগর গ্রামের হানেফ আলী, শ্রীরামপুর গ্রামের লিটন ও কুষ্টিয়ার পিয়ারপুরের রাইসুল ইসলামকে হত্যা করে দায় স্বীকার করে ক্ষুদে বার্তা পাঠায় জাসদ গণবাহিনীর পরিচয়ে কালু। সে হত্যা মামলায় পুলিশ ও র্যাব এ হত্যাকান্ডের প্রকৃত তথ্য উদঘাটনে মাঠে নামেন। কালুর ঘনিষ্ঠ সহযোগি কুষ্টিয়া জেলার ইবি থানার দুর্বাচারা গ্রামের আজিজুর রহমানের ছেলে জাহাঙ্গীর কবির লিপটন এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে শৈলকুপা থানা পুলিশ ঘটনা তদন্ত শেষে নিশ্চিত হয়েছে।