

রবিবার ● ৬ জুলাই ২০২৫
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম » লাশ আনার পথে তারাও লাশ হয়ে ফিরলেন
লাশ আনার পথে তারাও লাশ হয়ে ফিরলেন
ফটিকছড়ি প্রতিনিধি :: দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দুইভাই এলেন লাশ হয়ে। যাওয়া হলনা ঘরে। মসজিদ আঙ্গিনায় হল শেষে ঠিকানা। জানাযা নামাজের জন্য অপেক্ষারত হাজার হাজার মানুষ।
খবর দিয়ে আনা হল জন্মদাত্রী মা ও বোনদের শেষ দেখা দেখার জন্য।
‘বিভৎস সন্তানের লাশ দেখার সুযোগ নেই মা আনোয়ারার। বাকশক্তি রুদ্ধ। গাড়ি থেকে যখন নামানো হলো লাশের খাটিয়া, এগিয়ে এসে তিনি তা স্পর্শ করলেন। বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে বললেন, ‘বাবা তোমরা না তোমাদের বাবাকে দেখে রাখতে বলেছিলে? একবার কথা বল, শুধু একবার’- সন্তানদের উত্তর মেলেনা। আনোয়ারা বেগমের বুঝতে বাকী নেই এই খাটেই চির নিদ্রায় তাঁর আদরের দুই সন্তান।
গেল শনিবার মধ্যরাতে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর এলাকার ছোট্ট একটি গ্রাম তালুকদার পাড়ায় শত সহস্র মানুষ এমন মর্মান্তিক দৃশ্য দেখেছে, নিরবে ভেসেছে চোখের জলে।
আনোয়ারা বেগমের ছয় সন্তান। তিন ছেলে আর তিন মেয়ে। মেঝ ছেলে মোহাম্মদ রুবেল (২৭) গত বছর সৌদি আরবে চরম নির্যাতনে শিকার হয়ে নিহত হন। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে শনিবার তার মরদেহ ঢাকা বিমান বন্দর থেকে গ্রহণ করেন বড় ভাই মোহাম্মদ বাবুল (৩৭) ও ফুফাত ভাই মো. ওসমান গণি (৩৫)। বিকেলে লাশবাহী এ্যম্বুল্যান্সটি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বাতিসা এলাকায় পৌঁছালে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান মোহাম্মদ বাবুল এবং ওসমান গণি। সড়কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃত্যুর খবরটি ছড়িয়ে পড়লে উপজেলার সর্বত্রই নামে শোকের ছায়া।
নিহতের স্বজনরা জানান, রুবেল পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে ২০২৪ সালে সৌদি আরব পাড়ি দেন। সেখানে দোকান মালিকের অনুমতি ছাড়া একটি বার্গার খেয়ে তিনি শারিরিক নির্যাতনে গুরুতর আহত হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গত বছরের ১৭ জুলাই রুবেল মারা যান। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার লড়াই শেষে শনিবার তার নিথর দেহ দেশে ফেরে।
নিহত ওসমান গণির ফুফাতো ভাই মাসুদ তালুকদার বলেন, ‘মেঝ ভাই রুবেলের লাশ নিয়ে আসার পথে এক্সিডেন্টে বড় ভাই বাবুলও মারা যান। এই কষ্ট আমরা কীভাবে সই। এই বলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।’
নিহত রুবেল ও বাবুল তালুকদার পাড়ার ফুল মিয়ার ছেলে এবং ওসমান একই এলাকার আধা কিলোমিটার দুরে জয়নাল আবেদিনের ছেলে। তারা সম্পর্কে আপন মামাতো-ফুফাতো ভাই।
সেখানে গিয়ে দেখাযায়, রুবেল ও বাবুলের আদাপাকা ঘরের একটি কক্ষে স্বজনদের নিয়ে একটু পর পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন মা আনোয়ারা বেগম। উপার্জনক্ষম দুই সন্তানকে হারিয়ে কীভাবে সংসারের হাল ধরবেন, কীভাবে অন্যরা মানুষ হবেন, তা নিয়ে বিলাপ করছিলেন তিনি।
নিহত বাবুলের স্ত্রী সাহেদা আকতার বার বার অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন। ছোট্ট দুই কন্যাসন্তানকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন তিনি। সাহেদা আকতার বলেন, ‘আমি এখন সন্তানদের কী জবাব দেবো। কী নিয়ে বাঁচবো। কে দেবে তাদের সান্তনা?
বাড়ির উঠোনজুড়ে স্বজন হারানোর আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী। সংসারের উপার্জনক্ষমদের হারিয়ে অন্যদের মধ্যে হতাশা ভর করেছে। প্রতিবেশী ও স্বজনরা শোকাহত পরিবারগুলোকে সান্তনা দিতে বাড়িতে ভিড় করেন। তাদের কান্নার শব্দ ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে।
১৭ বছর বয়সী রুবেলের ছোট বোন রুম্পা আকতার কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘ভাইয়েরাই ছিলো আমাদের ভরসার জায়গা। বাবা-মায়ের আশ্রয়স্থল। হে আল্লাহ আমাদের এ কী করলে তুমি, কেন করলে?
গ্রামের কিছু দুরে নিহত ওসমানের বাড়ি। ওসমান উপজেলার তালিকাভুক্ত ঠিকাদার তিনি। একথা বলেই বিলাপ করেন স্ত্রী নুসরাত জাহান শিমা। দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে কিভাবে তিনি বাঁচবেন এ নিয়ে উৎকন্ঠায়। শিমা বলেন, ‘দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগেও লাশ নিয়ে ফিরেছেন বলে কথা হয়। কিন্তু তিনি ফিরলেন কফিনে বন্দি লাশ হয়ে।’
শনিবার মধ্যরাতে রুবেল আর বাবুলের লাশ গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরেই আসে ওসমানকে বহনকারী লাশের গাড়িটি। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় মসজিদ মাঠে কবরস্থানে। লাশের পিছে পিছে ছুটে চলে শত সহস্র মানুষ। নিঃশব্দে আহাজারি করছিলেন অনেকে।
ফটিকছড়িতে সড়কের গাছ কাটলেন প্রধান শিক্ষক
ফটিকছড়ি :: চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) একটি সড়কের গাছ কেটে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
গত শুক্র ও শনিবার দুইদিনে উপজেলার নারায়ণহাট এলাকায় এসব গাছ কাটা হয়।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের নাম মো. হারুন উর রশীদ। তিনি উপজেলার নারায়ণহাট ইউনিয়নের পশ্চিম ইদলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। গাছ কাটার কথা স্বীকার করে ওই শিক্ষক ‘মৌখিক’ অনুমতি নেওয়ার কথা বললেও বনবিভাগ বলছেন তারা জানেন না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ফটিকছড়ি-হেঁয়াকো প্রধান সড়ক হতে হালদা ভ্যালি চা-বাগান সংযোগ সড়কের পাশে রোপিত প্রায় ৪০টি ইউক্যালিপ্টাস ও আকাশমনি গাছ দুইদিন ধরে দিনে দুপুরে কেটে ফেলেন। এসব গাছ স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী ‘পালসার নাছির’ নামে এক ব্যক্তির কাছে মোটা অংকের বিনিময়ে বিক্রি করেন। এবং পরবর্তীতে তারা ছয় ভাই-বোন মিলে ভাটোয়ারা করেন। এসব গাছ কাটায় বন বিভাগের ‘মৌখিক’ অনুমতি নিয়েছেন বললেও কাগজে-কলমে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি ওই প্রধান শিক্ষক।
প্রধান শিক্ষক মো. হারুন উর রশীদ জানান, ‘সড়কটির পাশে তার পৈতৃক জমি রয়েছে। দীর্ঘকাল পূর্বে গাছগুলো আমার পরিবার রোপন করেছেন। আশেপাশের অনেকেই এ ধরনের গাছ কেটেছেন। তারাও কোন অনুমতি নেয়নি। আমি ‘মৌখিক’ বনবিভাগের লোকজনকে অবহিত করলেও কাগজে-কলমে অনুমতি লাগবে সেটি বুঝিনি। সেটা আমার অপরাধ হয়েছে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, সরকারি সড়কের গাছ শিক্ষকের ব্যক্তিগত মালিকানায় পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। এটি সম্পূর্ণ অবৈধ ও লোভপ্রসূত কাজ। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
উপজেলার নারায়নহাট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) মো. সদস্য নাসির উদ্দিন বলেন, ‘বন বিভাগ থেকে এসব গাছ কাটার অনুমতি প্রয়োজন। অতচ তিনি কাউকে না জানিয়ে সড়কের গাছ কেটে বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি একজন শিক্ষক হিসেবে এভাবে সরকারি গাছ কাটার অধিকার তার আছে বলে জানানেই।’
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) হাসান মুরাদ চৌধুরী বলেন, ‘একজন শিক্ষক হয়ে এমন গর্হিত কাজ করতে পারেন না তিনি। এটি মোটেও ঠিক হয়নি।’
উপজেলা প্রকৌশলী তন্ময় নাথ বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী ব্যক্তি পর্যায়ে সরকারি সড়কের গাছ কাটার কোন নিয়ম নেই। গাছ কাটতে হলে বিধিবিধান অনুসরণ করতে হয়। বনবিভাগের ছাড়পত্র নিতে হয়। নারায়ণহাটের শৈলকূপা এলাকায় সড়কের অনেক গাছ এভাবে কাটা হয়েছে। সবার জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’